নিজস্ব প্রতিবেদক | ২৮ অক্টোবর ২০২০ | ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ | 87 বার
সাম্প্রতিক অতীতে দেশবাসীকে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখতে হয়েছে। সিলেটে বন্দরবাজারে পুলিশ ফাঁড়িতে নির্দয় লাঠিপেটায় তরুণ রায়হানের অকালমৃত্যু হয়েছে। পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, ময়নাতদন্তে নিহত যুবকের শরীরে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। উপড়ে গেছে তার দুটি আঙুলের নখ। কী ছিল তার অপরাধ? বলা হচ্ছে, ছিনতাইকারী সন্দেহে ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। এমন অভিযোগও উঠেছে, তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য টাকা চাওয়া হয়েছিল। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয়, নিহত ব্যক্তি অপরাধী ছিলেন, তবুও কি পুলিশ তাকে এভাবে নির্যাতনের অধিকার রাখে?
পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা এদেশে যে খুব নতুন কোনো বিষয়, তা কিন্তু নয়। বছরখানেক আগে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে তাসলিমা নামে এক নারী গণপিটুনিতে নিহত হন। জানা যায়, ভদ্রমহিলা তার সন্তানের ভর্তির ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে ওখানে একটি স্কুলে গিয়েছিলেন। প্রায় একই সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক ব্যক্তি ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনির শিকার হন। কিছু বিপথগামী ছাত্রনেতার নির্দয় পিটুনির শিকার হয়ে বুয়েটছাত্র আবরারের মৃত্যুর ঘটনা তো এখনও তরতাজা। যত দূর মনে পড়ে, নব্বইয়ের দশকে দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু উচ্ছৃঙ্খল রাজনৈতিক কর্মীর হাতে এভাবেই রাতভর পিটুনির শিকার হয়ে এক ছাত্র বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছিলেন। নিকট অতীতে দেশে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেছে, যার কোনো কোনোটিতে অভিযোগের তীর নিক্ষিপ্ত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে।
এই যে বেধড়ক পিটুনি, যা ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা কি হত্যার উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে? রাস্তাঘাটে ‘ছেলেধরা’, পকেটমার কিংবা ছিনতাইকারী সন্দেহে উচ্ছৃঙ্খল জনতা যখন কাউকে পিটুনি শুরু করে, তখন সেখানে আসলে কোনো উদ্দেশ্য কাজ করে না। এটা স্রেফ অপরাধকাণ্ডের প্রতি মানুষের আক্রোশ, আইনি ব্যবস্থার প্রতি এক রকম অশ্রদ্ধা ও অনাস্থা। সেই সঙ্গে এসব ঘটনায় মানুষ যে অনেক সময় কত অবিবেচক ও নিষ্ঠুর হতে পারে, তারও দেখা মেলে। খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে, যে লোকগুলো এভাবে একজনের ওপর হামলে পড়েছে, তাদের বেশিরভাগই তেমন কিছু না জেনে স্রেফ হুজুগের বশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কে কার চেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে তার কসরৎ করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মাঝেমধ্যে অপরাধী কিংবা সন্দেহভাজন অপরাধীদের থানায় ধরে নিয়ে পেটানোর ক্ষেত্রে পুলিশের কী মনস্তত্ত্ব কাজ করে? এখানেও নিশ্চয় হত্যার উদ্দেশ্য কাজ করে না। হত্যাই যদি উদ্দেশ্য হবে, তাহলে পিটিয়ে মারতে হবে কেন? এ দেশের মানুষ তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে অনেক সমাজবিরোধীর মারা পড়ার খবর শুনে আসছে। এসব ক্ষেত্রে ‘পিটুনি’ অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়েছে বলে কখনও শুনেছেন? একজন মানুষকে কতটা নিষ্ঠুরভাবে পেটালে তা এমনকি মৃত্যু ডেকে আনতে পারে?
মনুষ্যসমাজে ব্যথা-বেদনা, তা দৈহিকই হোক কিংবা মানসিক, মানুষকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করে। খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে, মানুষ যত রকম ওষুধ খায়, তার মধ্যে ব্যথার ওষুধ একটা বড় অংশ দখল করে আছে। মানুষ যখন শারীরিক বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, ব্যথা-বেদনায় কাতরায়, তখন আশপাশে যেই থাকুক ছুটে আসে, সমব্যথী হয়। যে যেভাবে পারে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সেখানে একজন মানুষকে পেটানো, পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলা- এটা কোনো মানুষের কাজ হতে পারে? এ কারণেই মানব সমাজে ‘অমানুষ’, ‘নরপশু’, ‘নরপিশাচ’- এসব শব্দ প্রচলিত। যে কসাই প্রতিদিন কয়েকটা গরু-খাসি জবাই করে, কেটে টুকরো টুকরো করে, তাকে একজন মানুষের গায়ে একটা কোপ দিতে বলেন, তারও অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে। মানুষ যখন অমানুষ হয়ে যায়; অন্যের গায়ে হাত তুলতে, নির্যাতন-নিপীড়ন করতে, এমনকি তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে তার হাত এতটুকু কাঁপে না। তার হৃদয়ে কোনো অনুভূতি হয় না, বরং এতে সে এক রকম বিকৃত, পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করে। মানুষের এই অমানুষে রূপান্তর একদিনে হয় না। অপরাধ জগতে কেউ যখন পা রাখতে শুরু করে, প্রথম প্রথম তার বিবেক হোঁচট খায়, বিদ্রোহ করে। তবে ধীরে ধীরে সে এর সঙ্গে অভিযোজিত হতে থাকে, অপরাধবোধ দুর্বল হয়ে আসে, বিবেক মরে যায়। তখন তার কাছে আর অপরাধকে অপরাধ বলে মনে হয় না।
এ দেশের পুলিশ বাহিনীর বৃহত্তর অংশ জনবান্ধব, সমাজহিতৈষী। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা, জনগণের জানমাল রক্ষায় তারা নীরবে অতুলনীয় ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ৯৯৯ কলে সাড়া দিয়ে তারা যেভাবে অনেক নারীর ইজ্জত বাঁচিয়েছেন, তা তাদের জনবান্ধব ভূমিকার ছোট্ট একটি উদাহরণ। করোনা মহামারির এ দুর্যোগকালে মানুষের সেবায় দেশের পুলিশ বাহিনী অকাতরে কাজ করে গেছেন। তা করতে গিয়ে অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এমনকি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। এ সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে তারা কেন সামগ্রিকভাবে গুটি কয়েক অপরাধপ্রবণ পুলিশ সদস্যের অপকর্মের দায় কাঁধে নেবেন? দুর্নামের ভাগী হবেন? কাজেই, এটার একটা আশু বিহিত হওয়া দরকার।
এ জন্য পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের একটা পদ্ধতি চালুর বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর স্বচ্ছ রেকর্ডধারী, বিচক্ষণ ও চৌকস সদস্য এবং পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি ইউনিট গঠন করা যেতে পারে, যাদের দায়িত্ব হবে সার্বক্ষণিক নজরদারি। অপরাধী কিংবা সন্দেহভাজন অপরাধীর ইন্টারোগেশন থেকে শুরু করে থানা পর্যায়ের সার্বিক কার্যক্রম সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে, যার রেকর্ড নিয়মিতভাবে সংরক্ষণ করা হবে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হবে। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কেউ যেন অহেতুক ভুয়া অভিযোগ তুলতে না পারে, তার জন্য ‘বডি ক্যামেরা’র প্রচলন করা যেতে পারে। তবে, সবার ওপরে যেটা দরকার, তা হলো রাজনৈতিক সংকল্প।
অধ্যাপক, ফার্মাসি বিভাগ, জাবি
বাংলাদেশ সময়: ১০:১৪ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২৮ অক্টোবর ২০২০
ajkervabna.com | md anowar
©- 2021 ajkervabna.com কর্তৃক সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত।